ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলী বাহিনীর হামলায় তিনজন ফিলিস্তিন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত অঞ্চলটিতে সাংবাদিকদের নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৬-এ দাঁড়িয়েছে। শনিবার (২৩ মার্চ) গাজার মিডিয়া অফিস এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে। খবর ইয়েনি সাফাক।
এছাড়া গত ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ৩২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৭৪ হাজার ৩০০ জন মানুষ।
নিহত সাংবাদিকদের নাম মোহাম্মদ আল-রিফি, আবদুল রহমান সাইমা এবং মাহমুদ ইমাদ ইসা। গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই সাংবাদিকদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে ইসরাইল।
এক বিবৃতিতে গাজার মিডিয়া অফিস জানিয়েছিল, ‘ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর রোধ করতে, তথ্য আড়াল করতে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জনগণের কাছে তথ্য পৌঁছাতে বাধা দেওয়ার জন্য ইসরাইল ইচ্ছাকৃত-ভাবে গাজায় সাংবাদিকদের হত্যা করেছে।’
এর আগে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) গত মাসে তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বিগত ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে নিহত ৯৯ জন সাংবাদিকের মধ্যে ৭৭ জনই গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে মারা গেছেন। এদের মধ্যে তিনজন লেবানিজ ও দুজন ইসরায়েলি সাংবাদিকও রয়েছেন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শুধু সাংবাদিকদেরই নয়, গাজায় অনেক সাংবাদিকের পরিবারের সদস্যদেরও হত্যা করা হয়েছে।
সিপিজের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি দেশে সারা বছর যতজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের তিন মাসে তার চেয়েও অধিক সাংবাদিক মারা গেছেন।
সিপিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জোদি গিন্সবার্গ বলেছেন, গাজায় সাংবাদিকরা সম্মুখ সারিতে ছিলেন। তিনি বলেন, এ যুদ্ধে ফিলিস্তিনের সাংবাদিকদের যে অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে, তাতে এ অঞ্চল ও তার বাইরে সাংবাদিকতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। একজন সাংবাদিককে হত্যা বিশ্বকে বোঝার নতুন ইঙ্গিত বহন করে।
প্রসঙ্গত, গত ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ৩২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৭৪ হাজার ৩০০ জন মানুষ। ইসরাইলের হামলায় এই অঞ্চলের বেশিরভাগ জনসংখ্যাই অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে ৬০ শতাংশ। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র ঘাটতির মধ্যে আছে জনগণ।
এদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাবে গত শুক্রবার (২৩ মার্চ) ভেটো দিয়েছে রাশিয়া ও চীন।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলকে কোনো প্রকার চাপে না রেখে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনায় ওয়াশিংটনকে উপহাস করে মস্কো জানিয়েছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের এ 'ভণ্ডামি' পর্যবেক্ষণ করছে।
এর আগে, নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির একাধিক প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে ভেটো দেয় রাশিয়া ও চীন, আলজেরিয়া বিপক্ষে ভোট দিয়েছে এবং গায়ানা বিরত ছিল। স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স ও ব্রিটেনসহ নিরাপত্তা পরিষদের অন্য ১১ সদস্য পক্ষে ভোট দিয়েছে।
জাতিসংঘে রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, 'ইসরায়েলের লাগাম টেনে ধরার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করছে না। গাজাকে পৃথিবী থেকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার পর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনায় ওয়াশিংটনকে উপহাসও করেন তিনি।
ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত এই ভণ্ডামি পর্যবেক্ষণ করছি। আমেরিকানরা অতিমাত্রায় রাজনৈতিক, তাদের উদ্দেশ্য ভোটারদের নিয়ে খেলা এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির কথা উল্লেখ করে তাদের সামনে একটি হাড় ছুঁড়ে মারা। প্রস্তাবটি ইসরায়েলের দায়মুক্তি নিশ্চিত করবে। খসড়াতে তাদের অপরাধ মূল্যায়ন করা হয়নি।
অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন গাজায় আরও দুটি হাসপাতাল রোববার (২৪ মার্চ) অবরোধ করেছে ইসরায়েলি সেনারা। এতে তুমুল গোলাগুলির মধ্যে আটকা পড়েছেন চিকিৎসাকর্মীরা। হামলার মুখে একটি হাসপাতাল থেকে রোগী ও আশ্রয় নিয়ে থাকা মানুষদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের রেড ক্রিসেন্ট।
গাজার হাসপাতালগুলোকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে বলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে আসছে। তবে হামাস ও হাসপাতাল কর্মীরা এমন অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট বলেছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস নগরীতে গোলা হামলা চলার মধ্যে আল-আমাল ও নাসের হাসপাতালের আশেপাশে একটি ইসরায়েলি ট্যাংক হুট করে ঢুকে পড়ায় তাদের এক কর্মী নিহত হয়েছেন।
এক বিবৃতিতে দাতব্য সংস্থাটি বলেছে, আল-আমাল হাসপাতাল ঘিরে ফেলে ইসরায়েলি সেনারা বুলডোজার দিয়ে অভিযান চালাচ্ছে। আমাদের সব কর্মী এ মুহূর্তে চরম বিপদের মধ্যে আছে। কারণ, তাদেরকে বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
সংস্থাটি আরও বলেছে, ইসরায়েল আল আমাল হাসপাতাল সম্পূর্ণ খালি করে দেয়ার দাবি জানাচ্ছে। হাসপাতালটিতে কর্মী ও রোগীদের পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত মানুষেরাও আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাদেরকে বের করার জন্য ইসরায়েল স্মোক বোমা ছুঁড়ছে।
হামলার মুখে যেসব রোগীকে সরানো সম্ভব ছিল তাদেরকে পশ্চিমের আল মাওয়াসি উপকূলীয় এলাকায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে রেড ক্রিসেন্ট। সংস্থাটি এর আগে ইসরায়েলের গুলিতে হাসপাতালে আশ্রয় নেওয়া এক উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনির মৃত্যু হওয়ার খবর জানিয়েছিল।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বলছে, তারা খান ইউনিসের জঙ্গি অবকাঠামোতে হামলা চালাচ্ছে।
খান ইউনিসের বাসিন্দারা বলছে, ইসরায়েলি বাহিনী আরও এগিয়ে গিয়ে নগরীর পশ্চিমাঞ্চলের নাসের হাসপাতাল চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। স্থলভাগ থেকে ভারি গোলা ছুঁড়ে তারা অগ্রসর হচ্ছে।
ইসরায়েল এর আগে গাজার প্রধান আল শিফা হাসপাতালে অভিযান চালায়। টানা কয়েক দিন ধরে গাজার আল-শিফাতে অভিযান চালিয়ে ৪৮০ যোদ্ধাকে বন্দি করার দাবি করেছে ইসরায়েল। আল শিফার পরই খান ইউনিসের হাসপাতাল অবরোধ করল ইসরায়েলি সেনারা।