নিমতলী ট্র্যাজেডি কিংবা চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা মনে পড়লে এখনও আঁতকে উঠে রাজধানীবাসী। এই দুই দুর্ঘটনায় প্রায় দুইশ’ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। রাজধানীর পুরান ঢাকায় প্রথম দুর্ঘটনাটি (নিমতলী ট্র্যাজেডি) ঘটে ২০১০ সালে। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর পরই সিদ্ধান্ত হয় পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের। কিন্তু একযুগের বেশি সময় পার হলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি সেই সিদ্ধান্ত। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শঙ্কায় দিন কাটছে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের। একেরপর এক ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয় মানুষ, বাড়ে মৃত্যু এবং হতাহতের সংখ্যা। আগুনের কোনও ঘটনা ঘটলে কিছুদিন চলে প্রশাসনের তোড়জোড়। কিন্তু দিনশেষে পরিস্থিতি আর বদলায় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা’ এবং ‘ব্যবসায়ীদের অনীহার’ কারণেই দীর্ঘ এক যুগের চেষ্টাতেও পুরান ঢাকা থেকে কোনও ব্যবসায়ীকে স্থানান্তর করতে পারেনি বিগত সরকার। এবার ক্ষমতার পালাবদলের পর জোরেশোরে প্রশ্ন উঠেছে, পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তর হবে কবে? অন্তর্বর্তী সরকার কি পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তর বাস্তবায়নের দিকে নজর দেবে?
২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর অগ্নিদুর্ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যুর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩১টি সুপারিশ দেয়। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন প্রাণ হারান। গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ ছিল পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেওয়া। ওই সময়ে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম সরানো সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি ২০১১ কেরানীগঞ্জে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদামগুলো সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সম্মতি না পাওয়ায় ওই উদ্যোগ সফল হয়নি।
পরবর্তী সময়ে চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে শ্যামপুরের উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির ৬ একর জমিতে ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর পুরান ঢাকার রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের স্থানান্তরে গুদাম তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে গুদাম তৈরির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও জুনে প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে। ৪ জুন উদ্বোধন হলেও এখন পর্যন্ত সেখানকার একটি গুদামঘর ভাড়া হয়েছে। যে গুদামঘরটি ভাড়া হয়েছে, সেটিও অন্য এলাকা থেকে এসেছে।
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের স্থানান্তর করতে দফায় দফায় গত এক দশকে কয়েক'শ সভা হয়েছে। সেসব সভায় দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্তক্রমে সবশেষ ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বিসিক কেমিক্যালপল্লি ঢাকা প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের আকার ধরা হয় ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। বিসিকের এই প্রকল্পের আওতায় কেরানীগঞ্জের ব্রাহ্মণকীর্ত্তা মৌজায় ৫০ একর জমি চিহ্নিত করে ৯৩৬টি প্লট তৈরির কথা বলে। প্রকল্প সংশোধন করা হয় চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর। এরপর স্থান চিহ্নিত করা হয় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে। এখানে ৩০৮ দশমিক ৩৩ একর জমি নিয়ে বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তবে কবে নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে তা কেউ জানে না।
রাসায়নিক গুদাম সঙ্গে নিয়ে কতটা সাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের সেই প্রশ্ন করতেই অনেকের নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা মনে করে গভীর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীর বাসিন্দা সাজেদা বেগম বলেন, স্বামীর চাকরির সুবাদে এই এই এলাকায় দীর্ঘ ২২ বছরের বসবাস। নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। মানুষের চিৎকার, বাসাবাড়ি থেকে আগুনে পোড়া একের পর এক লাশ বের করার মর্মান্তিক দৃশ্য এখনও চোখের সামনে ভাসে।
নিমতলী ট্র্যাজিডিতে ভাই হারানো শফিকুল ইসলাম বলেন, নিমতলীর আগুনে এতগুলো মানুষ মারা গেলো। অথচ কারও বিচার হলো না। আমরা ওই ঘটনার বিচার চাই। আমরা স্থানীয়রা পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়ে বহুবার রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার তা আমলে নেয়নি। কারণ যতো রাসায়নিক গুদাম আছে বেশিরভাগের পেছনে প্রভাবশালীদের হাত ছিল। আমাদের প্রত্যাশা নতুন এই সরকার পুরান ঢাকার মানুষের জানমালের কথা চিন্তা করে হলেও এখান থেকে রাসায়নিক গুদাম সরাবে।
পুরান ঢাকার আরেক বাসিন্দা মোবারক আলী বলেন, ‘পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা নিমতলীর ওই ঘটনা থেকে পরে কোনোধরনের শিক্ষা নেয়নি। যদি নিতো তাহলে সচেতন হতো এবং পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানোর চেষ্টা করতো। সত্যি বলতে চেষ্টা করেছে কিন্তু তৎকালীন সরকার তার তোয়াক্কাই করেনি। তারা রাসায়নিক গুদাম সরানোর বিষয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা রক্ষা করেনি। এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে আমরা মুক্তি চাই। পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরবে কবে?’
নিমতলীর আগুনের ঘটনার পর রাসায়নিক গুদাম সরানোর কথা। কিন্তু যুগ পেরিয়ে গেলেও তা সম্ভব হয়নি। অথচ পুরান ঢাকাতে প্রায়ই ছোট-বড় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। অগোচরেই এসব রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে। তিনি বলেন, পুরান ঢাকার যেসব বাড়িতে গুদাম আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে বাড়ির সামনে লাল চিহ্ন দিয়ে দেওয়া হোক। এসব বাড়ি আবাসিক হিসেবে ভাড়া দেওয়াও বন্ধ করতে হবে। এতে সাধারণ মানুষ সচেতন হবে।
নিমতলীর ৪৩ নবাব কাটারার পাশেই নিহত লোকজনের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মুকিত মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটলে সরকার এসব রাসায়নিক গুদাম সরানোর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় না। সরকারের যেসব সংস্থা আছে, প্রত্যেকের এখানে দায়িত্ব আছে। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদেরও দায়িত্ব আছে। তারা যদি ভাড়া না দেয় তাহলে কিন্তু এখানে আর রাসায়নিক গুদাম হওয়ার সুযোগ নেই।
এই বাসিন্দা আরো বলেন, পুরান ঢাকার অলিগলি সরু, জরুরি মুহূর্তে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে না। এখানকার বাড়ির মালিকদের রাসায়নিক গুদাম ভাড়া দেওয়া উচিত নয়। মহল্লাগুলোতে পঞ্চায়েত কমিটির উচিত এসব দেখভাল করা। তিনি বলেন, ‘বছরের পর বছর চলে গেল, আমাদের দুঃখের কথা শেষ হয় না। এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক, সেটাই চাওয়া।’
পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তর নিয়ে ব্যবসায়ীরা কী ভাবছেন তা জানতে কথা হয় পুরান ঢাকার বেশকয়েকজন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে। গুদাম স্থানান্তরে তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা— ‘স্থানান্তরের স্থানে গুদাম গেলে ঠিকমতো ব্যবসা হবে কিনা।’ সায়েদুল ইসলাম নামের একজন কেমিক্যাল ব্যবসায়ী বলেন, পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের জমজমাট ব্যবসা হচ্ছে। কোনও ব্যবসায়ী চাইবে না এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে। তবে হ্যাঁ, যেহেতু এখানে বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই শঙ্কায় স্থানান্তরের উদ্বেগকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, এখান থেকে স্থানান্তর করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে করতে হবে। দেখা গেলো সরকারের উদ্যোগে ৫০ বা ১০০ জনকে স্থানান্তর করা হলো, বাকিরা এখানে রয়ে গেলো। তারা এখানে তাহলে একচেটিয়া ব্যবসা করবে। কারণ এখানে তো ব্যবসার জমজমাট। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। এবং সব ব্যবসায়ী যেন নির্দিষ্ট স্থানে কেমিক্যাল ব্যবসা করে তা নিশ্চিত করতে হবে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে সরকার যদি কঠোর পদক্ষেপ নেয়, তবেই স্থানান্তর সম্ভব।
পুরান ঢাকার বেশ কয়েকজন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শ্যামপুর বা নির্মাণাধীন টঙ্গীর অস্থায়ী গুদাম ব্যবহারে তারা আগ্রহী নন। কারণ কেমিক্যাল জাতীয় পণ্যের ব্যবসায়ীদের তুলনায় গুদামের সংখ্যা অনেক কম। ফলে বিচ্ছিন্নভাবে সেখানে গিয়ে ব্যবসায়ীদের লোকসানের মুখে পড়তে হতে পারে। শ্যামপুর বা টঙ্গীর অস্থায়ী কেমিক্যাল গুদামে পুরান ঢাকার ১ ভাগ কারখানাও স্থানান্তর হবে না। তারা মূলত স্থানান্তর হতে রাজি তবে সবাইকে একসাথে স্থানান্তর করার শর্তে।
ব্যবসায়ীরা জানান, পুরান ঢাকায় প্রায় ২ হাজার বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল জাতীয় কারখানা রয়েছে। আর শ্যামপুরে গুদামঘর করা হয়েছে মাত্র ৫৪টি। পাশাপাশি ২০২০ সালের মার্চে শুরু হওয়া টঙ্গীর গুদামঘর তৈরির কাজ ৭০ ভাগ শেষ হয়েছে। টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া মৌজায় বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার (বিএসইসি) ৬ একর জমিতে ৫৩টি অস্থায়ী গুদাম তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। পাশাপাশি ১ লাখ গ্যালন ধারণ ক্ষমতার একটি ওভারহেড, একটি আন্ডারহেড পানির ট্যাংক নির্মাণ, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ও ট্রান্সফরমার স্থাপন করা হবে। এই স্বল্প পরিমাণ গুদাম পুরান ঢাকা থেকে স্থানান্তর করে পুরান ঢাকার পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হবে না। এজন্য মুন্সীগঞ্জের কাজ দ্রুত বাস্তবায়নের অনুরোধ জানান তারা। এছাড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেলে তাদের ব্যবসায়িকভাবেও ক্ষতির শিকার হতে হবে।
পুরান ঢাকার অগ্নিদুর্ঘটনা কমাতে হলে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে মনে করেন বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) প্রকৌশলী আলী আহমেদ খান। রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরে বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ী এবং ভবন মালিকরা শুধু তাদের লাভ চিন্তা করছেন। কিন্তু অগ্নিনিরাপত্তাও যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তারা সেটা আমলে নিচ্ছেন না। গুদাম স্থানান্তরে এর আগে নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা শুনেছি। কিন্তু কার্যকরী কিছু হয়নি। ব্যবসায়ীরা যদি কথা না শুনে তাদের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু বিগত সরকারের সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপার তেমন কোনও কার্যকর তৎপরতা ছিল না। আশাকরি এবার দ্রুত সময়ের মধ্যে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হবে। নয়তো পুরান ঢাকায় ফের যে কোনও মুহূর্তে বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনার শঙ্কা থাকছেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মুখপাত্র মো. আবু নাছের বলেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরে কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়নসহ অন্য যেসব কাজ আন্তঃমন্ত্রণালয় থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে (ডিএসসিসি) দেওয়া হয়েছে তা করা হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কমিটিগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে ডিএসসিসি। পুরান ঢাকাকে বাসযোগ্য ও নিরাপদ রাখতে ডিএসসিসি সব ধরনের কাজ করতে প্রস্তুত।