মাকে চিনতে একটা মেয়ের
সময় লাগে অনেক বছর, এই অনেক বছরের নির্দিষ্টতা নেই। সংখ্যায় কারো কম, আবার কারো বা
বেশি। তবে এই কম-বেশির মাঝামাঝি তেও বেশ লম্বা একটা সময় কেটে যায়। একটা সময় মায়ের
প্রতি ভীষণ বিরক্ত হতাম, কেমন জানি সব কিছু তে সহ্য হচ্ছে না, হচ্ছে না মনে হতো।
এমন মনে হতো যে ধুর, আম্মু কিছু বুঝে না, আম্মু সবসময়ই প্যারা দেয়, আচ্ছা আম্মু
সবসময় এতো গোয়েন্দাগিরি করে কেন? আমার সামান্য একটু জ্বর আসলে আম্মুর এতো বাড়াবাড়ি
কেন? জ্বরই তো হয়েছে সামান্য! মরণ রোগ তো হয়নি। আম্মুর সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি! আচ্ছা,
আম্মু এমন কেন? খিটখিটে মেজাজে থাকে প্রায়ই! ভালো করে তো দু চারটা কথা বলতে পারে।
কই? বলে না তো? এমন ছোট ছোট আরও শত শত অভিযোগ জমা হচ্ছিলো আম্মুর বিরুদ্ধে। সব
প্রকাশ করিনি, মাঝে মাঝে হয়তো কোনোটা প্রকাশ করতে গিয়ে বিরক্তিও দেখিয়েছি কতবার
তার হিসেব করা হয়নি। কিন্তু আজ একটা সময় পর মায়ের গুরুত্ব বুঝতে পারছি। জীবনের
কতটা জায়গা জুড়ে মায়ের অস্তিত্ব, জীবন সুন্দর করে গড়ে তুলতে মায়ের ভূমিকা ঠিক
কতটা, একটা সন্তানকে একজন মা কত কষ্ট করে তিলে তিলে বড় করে, কত যত্ন করে মা তার
সন্তান কে আগলে রাখে- এখন আমি সেটা বুঝতে পারি। এখন যে আমিও একজন মা!
সেদিন ছিলো বুধবার, ১লা
ফেব্রুয়ারী, ২০২৩। ঘড়িতে ঠিক দুপুর ১২.৪৫ মিনিট, আশেপাশের মসজিদের মাইকে জোহরের
আজান শোনা যাচ্ছিলো। সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম দিলাম এক ফুটফুটে পুত্র
সন্তানের। সবার খুশি দেখে কে? আমাকে যখন প্রথম বাচ্চার মুখ দেখানো হলো, আমি কেন
জানি কিছু বলতে পারছিলাম না, হাউমাউ করে কান্না করছিলাম শুধু৷ তবে সে কান্না ছিলো
সুখের, শুধু বারবার মনে হচ্ছিল এ আমার সাত রাজার ধন, এ আমার অমূল্য সম্পদ। সেদিন
মনে হয়েছিল মেয়ে হিসেবে আমার জন্ম সার্থক। সেইদিন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিলাম
এই আমি। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেডে দেওয়ার পর গলাকাটা মুরগির মতো যন্ত্রণা
হচ্ছিলো, কিন্তু পরক্ষণে বাচ্চার মুখের দিকে তাকাতেই সব ব্যথা, কাতরতা, যন্ত্রণা মুহূর্তেই
গায়েব হয়ে গেছিলো। আহা! কি পরম শান্তি! সে এক অভুলনীয় অনুভূতি। সাত দিনের দিন
বাচ্চার আকিকা দেওয়া হলো, নাম রাখা হলো আব্দুর রহমান আস সুদাইস। আমি বাচ্চার
জন্মের এক মাস আগে থেকেই আমার মায়ের কাছে ছিলাম। হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়ার পরও
শ্বশুর বাড়ি না এসে মায়ের কাছেই ছিলাম। সব মিলিয়ে দুই-আড়াই মাস হবে। জীবনের এই দুই
আড়াই মাসে আমি বুঝেছি মা কি!
আমাকে এবং আমার নবজাতক
সন্তানকে নিয়ে আমার মায়ের কতো ব্যস্ততা, কতো চিন্তা! মেয়ের খাবার-দাবার ঠিক আছে কি
না, সেলাই শুকালো কি না, সেলাইয়ে ইনফেকশন হচ্ছে না তো? মেয়ে কবে পুরোপুরি সুস্থ
হবে? মেয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছে কি না? আমি তখন আমার মা কে যত দেখতাম,
ততো বিমোহিত হতাম। একা হাতে সারাদিন সংসারের নানান কাজকর্ম, রান্নাবান্না, কাপড়
ধোয়া থেকে শুরু করে আমার এবং আমার ছেলের সম্পূর্ণ খেয়াল রাখতেন আমার আম্মু। এমন কি
সারাদিন এতো হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও সারারাতও ঘুমানোর সুযোগ পেতো না। আমার ছেলেকে
ফিডার বানিয়ে খাওয়ানো, একটু পর পর প্রসাব করে দিতো, ওর চেইঞ্জ করা, ওকে আবার ঘুম
পাড়ানো সবকিছু আমার আম্মু করতো। আর আমি? আরামে ঘুমাতাম! নয় দিনের বাচ্চা রেখে
যেদিন স্ট্রোক করলাম, সবাই হাউমাউ করে কান্না করতে পারলেও আমার আম্মু পারেনি।
আম্মু শুধু এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ওই যে কথায় বলে না অধিক শোকে পাথর?
তাই হয়েছিলো হয়তো বা। আল্লাহ আমার মায়ের বুক খালি করেনি, আমাকে মায়ের বুকে ফিরিয়ে
দিয়েছেন। শুকরিয়া।
আজ আমার ছেলের বয়স এক
বছর তিন মাস প্রায়। ওর বয়স যেদিন চল্লিশ দিন, সেদিনই চলে আসি শ্বশুর বাড়ি। শ্বশুর
বাড়িতে আসার পর প্রতি মুহুর্তে আম্মুর প্রয়োজনীয়তা আর গুরুত্ব অনুভব করতে লাগলাম।
চল্লিশ টা রাত আমার আর আমার ছেলের জন্য আমার আম্মু ঘুমায়নি, অথচ এখন আমাকে রাত
জাগতে হয়, ছেলেকে সামলাতে হয়। ওর সামান্য কিছু হলেই এখন আমি কান্না করি, এখন বুঝি
আম্মু কেন এমন করতো। আমার আম্মুর মাতৃত্বের তেইশ বছর। আম্মু কখনও খিটখিটে মেজাজে
কথা বললে রাগ দেখাতাম, অথচ আমার মাতৃত্বের সবে মাত্র এক বছর পেরিয়েছে, এরই মধ্যে
আমিও খিটখিটে হয়ে গেছি। মাকে চিনতে সময় লাগে অনেক বছর। আমি এখন একটু একটু করে আমার
মাকে চিনতে, বুঝতে শুরু করেছি। সময় যতো যাবে, আমি জানি আমার এই অভিজ্ঞতা আরও বাড়বে
বৈ কমবে না। এটা শুধু আমার নয়, প্রায় প্রতিটি ঘরেরই সাধারণ গল্প। কিন্তু এই
সাধারণের মাঝেও কিছু অসাধারণ বিষয় লুকিয়ে থাকে, যা কেবল উপলব্ধি তেই সুন্দর।
আজকের এই মা দিবসে মাকে
অন্তরের অন্তস্তল থেকে অবিরাম ভালোবাসা, সেই সাথে জীবনে ছোট ছোট করা ভুলের জন্য
ক্ষমা প্রার্থনা। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মা। ভালোবাসি আম্মু, অনেক ভালোবাসি।
লেখক: আফরিন আক্তার, শিক্ষার্থী, নরসিংদী সরকারি কলেজ।